ছবি সংগৃহীত
নূরে আলম সিদ্দিকী :আগুনঝরা ফাগুন মাসকে আমরা হৃদয়ের পরতে পরতে অনুভূতির কণায় কণায় রক্তিম আলপনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের উচ্ছ্বসিত অনুভূতিকে প্রকাশ করি প্রচ- আবেগে। যেদিন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিয়ে অভিলাষ ব্যক্ত করলেন, তখনই তখনকার পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী এই বাঙালিরা এই নির্মমতাকে মেনে নিতে পারেনি। তখন এই উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রধানতম নেতা জিন্নাহ সাহেবের এই নিষ্ঠুরতার ওপর অর্পিত বিশ্বাস ও তার মানসিক অস্তিত্বকে বাঙালি জাতীয় সত্তার প্রতি নিষ্ঠুর অভিব্যক্তি হিসেবে তারা গ্রহণ করেছিল। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের অবিসংবাদিত এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্বকে তখনকার ছাত্রসমাজ বাঙালি জাতীয় চেতনার সবটুকু আবির মাখিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিল। বাঙালির প্রতি এই নিষ্ঠুরতার জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সদ্য অর্জিত স্বাধীনতার সূর্যস্নাত প্রভাতে বাঙালির জন্য একটা নির্মম অভিশাপ নেমে আসল।
যে বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে এ দেশের মানুষ তখনকার দিনে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিল, সেই বিশ্বাসের ওপর এটি ছিল এক নির্মম নিষ্ঠুর আঘাত। বাংলা মায়ের সন্তানরা সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পাকিস্তানের সেই ঊষালগ্নে যে প্রতিবাদটুকু করেছিল, সেটি আন্দোলনের সোপান পেরিয়ে আস্তে আস্তে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করে। আজও আমি আশ্চর্যান্বিত হই, একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের আঙ্গিক থেকে গড়ে ওঠা জিন্নাহ সাহেব এমন একটি রক্ষণশীল এবং এই অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রতি এরূপ নির্মমতা প্রদর্শন করতে পারলেন কীভাবে! সেদিনের সেই প্রতিবাদটি সময়ের কালস্রোতে ভেসে বাঙালির আত্ম-অধিকারের আন্দোলনে শুধু রূপ পরিগ্রহই করেনি, জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণের অধিকার আদায়ে যে নিগূঢ় ঐক্যের পরিচয় দিয়েছিল, সেটিও পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ও বিস্ময়কর ঘটনা। আর সেই ঘটনার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ছাত্রদের দ্বারা সংঘটিত আন্দোলনের মাধ্যমে যে নিগূঢ় জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তারই প্রাথমিক বিজয় সংঘটিত হয় ১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে। কেন যে তারপরও পাকিস্তানি নেতৃত্ব অহমিকা থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না, বাঙালির এই নিগূঢ় ঐক্য দেখেও তাদের অবচেতন মনে কেনই বা কোনো প্রভাব ফেলল না, আজও তা ভাবলে বিস্মিত আমি হই। এই বাস্তবতাকে কেন তারা অনুধাবন করতে পারল না, তা ভেবে আজও আমি আশ্চর্যান্বিত হই। সেই ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে উৎসারিত আত্মত্যাগ ও বাঙালির নিগূঢ় ঐক্যবদ্ধ চেতনা এবং বিদগ্ধ চিত্তের উদ্বেলিত অনুভূতিকে কেন যে সেদিন তারা অবলোকন করতে পারেনি, আমি কেন, কোনো বিবেকবান মানুষেরই সেটি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
আমি আমার বহু নিবন্ধে উল্লেখ করেছি, ১৪০০ মাইল দূরে অবস্থিত থেকেও পূর্ববঙ্গের মানুষ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। সেদিন পাকিস্তান প্রস্তাবের জন্য লাহোর প্রস্তাবকেই কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। লাহোর প্রস্তাবে ছিল, মুসলিম অধ্যুষিত স্টেটসমূহের একটি কনফেডারেশন হবে। আমার মনে হয়, সেদিন যদি পূর্ব পাকিস্তানকে কলোনি বানানোর তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতৃত্বের দুরভিসন্ধিকে যদি বাঙালি আঁচ করতে পারত, তাহলে ১৯৪৬ সালে নির্বাচনে পাকিস্তানের পক্ষে কিছুতেই তারা ভোট দিত না। এখানে আরেকটি সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় কলকাতা এবং মুর্শিদাবাদকে পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত দেখানো হয়েছিল কিন্তু কৌশলে প্রাসাদচক্রের অভিসন্ধিতে কলকাতা এবং মুর্শিদাবাদকে রেডক্লিফের সেই মানচিত্র হতে ছেঁটে ফেলা হয় এবং এটা সুনিশ্চিত ছিল, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ ও কলকাতা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলে নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তানের রাজধানী হতো কলকাতা। করাচি, ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডির নামই আসত না। এই কৌশলটি করার সময় বাঙালির বিরুদ্ধে, এ দেশের মানুষের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি, তাদের অস্তিত্বকেই ধ্বংস করার জন্যই রেডক্লিফের সেই মানচিত্র বাস্তবায়িত হয়নি বা হতে দেওয়া হয়নি। সংগত কারণেই রেডক্লিফের সেই মানচিত্র আঁতুড়ঘরেই মৃত্যুবরণ করেছে।
পূর্ববাংলার মানুষ এই চক্রান্তটিকে হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করতে পেরেছিল বলেই, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর যৌথ নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টকে তারা শুধু বিপুল ভোটে বিজয়ীই করেনি, নুরুল আমিন সাহেবসহ মুসলিম লীগের রুই-কাতলাদের নেতৃত্বের অবসান ঘটিয়েছিল। খালেক নেওয়াজ খান নামে ছাত্রলীগের এক মধ্যপর্যায়ের নেতার কাছে নুরুল আমিন সাহেব পরাজিত হয়েছিলেন। পূর্ববাংলার গণমানুষের যে দায়িত্ব ছিল, তা তারা যথাযথভাবে পালন করলেও মুসলিম লীগের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কুটিল প্রবাহ বন্ধ হয়নি। জিন্নাহ সাহেব মৃত্যুবরণ করলেও বাংলার স্বার্থবিরোধী তখনকার সব নেতৃত্ব এমনকি খাজা নাজিমউদ্দিন তাদের কালো হাতের সঙ্গে করমর্দন করেন। যদিও বাংলার অকুতোভয় নেতা, দুর্দমনীয় সাহসী শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পাঞ্জা লড়তে মোটেও কুণ্ঠিত হননি, সময়ক্ষেপণও করেননি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখনকার সংসদে (যাকে কনস্টিটিউন্ট অ্যাসেম্বলি বলা হতো) সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দলের সদস্য ছিলেন মাত্র ১৩ জন। তাই সেখানে সামরিক জান্তা, আমলাতন্ত্র, পুঁজিপতি শাসনকর্তাদের একটার পর একটা ষড়যন্ত্রের ঘুঁটি চালা সম্ভব হয়েছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অকুতোভয়ে অপেক্ষা করছিলেন আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের জন্য। কারণ, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন তার মনে প্রতীতি ও প্রত্যয়ের জন্ম দিয়েছিল যে, সাধারণ নির্বাচন হলে মুসলিম লীগকে ধরাশায়ী করা বাঙালিদের পক্ষে অসম্ভব হবে না। তাই নির্বাচন আসার পূর্বেই ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান ফিল্ড মার্শালের পদবি নিয়ে তখনকার ইস্কান্দার মির্জার শাসনকে উৎখাত করে সামরিক শাসন জারি করে। সেই ’৫৮ সাল থেকে এই ১৩ বছর, সময়ের পরিমাপে খুব বেশি নয় এবং কেন্দ্রীয় সরকারে মুসলিম লীগের শাসন হলো ২৩ বছর। এই ২৩ বছরেই আবার বাঙালি, এই বাংলা মায়ের সন্তানেরা আপন গৌরবে নির্বাচনের মাধ্যমে সারা পাকিস্তানের নেতৃত্বের সৌভাগ্য অর্জন করে। মোট ৩০০টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৭ আসনের ১৬৫টি আসনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্ব যদি জানত, বাঙালিরা অন্তরে অন্তরে চেতনার মোহনায় সেই ’৫৪ সালের ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে, তাহলে হয়তো তারা ছলেবলে, কলে-কৌশলে নির্বাচনটিকেই বন্ধ রাখত। তীক্ষè সঙিন উঁচিয়ে তারা এই বাংলাকে শোষণের চারণক্ষেত্রই বানিয়ে রাখত। বাংলার মানুষের বুকের রক্ত জৌলকারের মতো যারা চুষে নিতে চাইত। যারা বাংলাকে তাদের কলোনি বলে ভাবত, তারা সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির এই অভূতপূর্ব ঐক্য অবলোকন করে অনেকটাই হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সভা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ওই অধিবেশনে যোগদানের জন্য অনেকেই তখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় এসে অবস্থান গ্রহণ করছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অকাট্য যুক্তির কাছে ও বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার প্রত্যয় বোধ থেকে তাদের বিবেক জাগ্রত হবে এমনটিই ছিল প্রত্যাশিত। জুলফিকার আলী ভুট্টোর ক্ষমতালিপ্সা এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অক্টোপাস তখনকার পাকিস্তানের বিবেকপ্রসূত নেতৃত্বকেও গ্রাস করে ফেলে। তাই জেনারেল ইয়াহিয়া ১ মার্চ একটি বেতার ভাষণে অকস্মাৎ ও অতর্কিতে তারই আহ্বান করা জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এরই প্রতিবাদে সারা বাংলাদেশ ভিসুভিয়াসের মতো জ্বলে ওঠে। এই আগুন থামাতে তাদের নিরীহ ও নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ করতে হয়। তবে এবারের বৈশিষ্ট্য ছিল, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এই নির্বিচার গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং নির্মম ধ্বংসলীলা নির্বিকারভাবে মেনে নেয়নি। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু যে আহ্বান করেছিলেন, “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো”- সেই অদ্ভুত অবিস্মরণীয় উদাত্ত আহ্বান বজ্রকণ্ঠের নিনাদের মতো সারা বাংলাদেশের সব প্রান্তর কাঁপিয়ে তুলেছিল। বাঙালিরা যার হাতে যা কিছু ছিল, বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত নির্দেশনা অনুসরণ করে তাই নিয়েই সশস্ত্র ও চৌকশ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে উদ্ধত চিত্তে প্রত্যয়দৃপ্ত মানসিকতায় সশস্ত্রভাবেই মোকাবিলা করেছিল। রাস্তায় প্রতিরোধ, গ্রামে প্রতিরোধ, বন্দরে প্রতিরোধ, বাংলার প্রতিটি কোনায় কোনায় প্রদীপ্ত অগ্নিশিখা জ্বলে উঠেছিল। সেই আসুরিক শক্তিকে ভস্মীভূত করার পর আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছর আমরা পেরিয়ে এসেছি। বৈশ্বিকভাবে আমাদের দেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করেছে, পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হয়েছে কিন্তু যেই গণতন্ত্রের জন্য এই বিরামহীন সংগ্রাম, বুক চিতিয়ে হিমাচলের মতো মাথা উঁচু করে সমস্ত বিশ্বকে অবাক করে যে গণযুদ্ধ তখনকার বাঙালিরা করেছিল, আজ সেই গণতন্ত্রেরই কোথায় যেন নিদারুণ অভাব।
এই গণতন্ত্র ও মূল্যবোধের নিদারুণ সংকটের জন্য আওয়ামী লীগকে এককভাবে দায়ী করা যাবে না। এখানে প্রধান বিরোধী দলে একটি অযাচিত, অমূলক ও অনর্থক আতঙ্ক, সংশয়, প্রত্যয়বোধের অভাব এবং নেতৃত্বের সংকট নানাভাবে দায়ী। প্রধান বিরোধী দলের যিনি সংগঠন প্রধান, সেই বেগম খালেদা জিয়া আজ অসুখে প্রায় শয্যাশায়ী বললে অত্যুক্তি হবে না। আর এই দলের যিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বা মূল চালিকাশক্তি, তিনি তো বাংলাদেশে আসতেই নারাজ। উদ্দীপ্ত মিছিলের অগ্রভাগে থেকে মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে উত্তোলন করে তিনি সেøাগান তুলতে নারাজ। তার কণ্ঠ হতে মিশ্রিত সেøাগান বাংলাদেশের মানুষ শুনতে চাইলেও সেটি আজ অসম্ভব প্রায়। অনেকে একটি দুর্বল ও খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে বলবেন, তারেক রহমান তো শাস্তি মাথায় নিয়ে রয়েছেন, তিনি বাংলাদেশে এলেই তো কারারুদ্ধ হয়ে যাবেন। তার উত্তরে আমার বিনম্র অভিব্যক্তি, মেঘে মেঘে ঘর্ষণ না লাগলে যেমন বিদ্যুৎ চমকায় না, মেহেদিকে না পিষলে যেমন তার ভিতরের রং বের হয় না, তেমনি নেতৃত্ব যদি আত্মত্যাগী না হন, যদি নির্যাতন নিগ্রহকে ভয় পেয়ে প্রবাসে বিলাসী জীবনযাপন করেন, সেই নেতৃত্বের পক্ষে জনগণকে আন্দোলনমুখী করা সম্ভব হয় না। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসানোর পরেই বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে অন্যান্য নেতৃত্বকে পেছনে ফেলে বঙ্গবন্ধুর অমোঘ ও অবিস্মরণীয় নেতৃত্বকে তাদের প্রত্যয় ও প্রতীতির সঙ্গে গ্রোথিত করে নেয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা না হলে এককভাবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সত্তরের নির্বাচনে এমন কালজয়ী বিজয় অর্জন করা সম্ভব হতো না। এটা শুধু তৎকালীন পাকিস্তানের নেতৃত্বের ক্ষেত্রেই নয়, সারা বিশ্বের এটি একটি বিস্ময়কর গণতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল। কায়েমি স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে বাঙালিরা যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তার প্রথম সত্তা ও শর্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি বাঙালিদের অলঙ্ঘনীয় বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র, নির্যাতন ও নিগ্রহের মধ্য থেকে। আমরা তখনকার তরুণ সমাজ দ্বিধাহীন ও নির্মোহ চিত্তে বঙ্গবন্ধুর পেছনে কাতারবন্দি হয়েছিলাম। তাঁকে নেতৃত্বের সম্মুখভাগে স্বর্ণরথে চাপিয়ে সেই রথ আমরা টেনেছিলাম। আমাদের বিশ্বাস ছিল, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব দূরে থাক, বিশ্ব শাসনের সুযোগ ও সুবিধা দিলেও বাংলার সাহসী পুরুষ বঙ্গবন্ধুকে ক্রয় করা যাবে না, জীবনের বিনিময়ে হলেও এই বাংলার একটি ধূলিকণা-পরিমাণ স্বার্থও তিনি বিক্রি করবেন না। তাই তাঁর জীবনের রথ গৌরবের পথে দৃপ্ত অভিযাত্রায় কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছিল। নিঃস্বার্থ নির্ভয় উদ্ধত উদগত চিত্তের সেই নেতৃত্ব বাংলাদেশের ছাত্র ও যুবসমাজের হৃদয়ের সিংহাসনে মুকুটহীন সম্রাটের মতো অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাই তিনি হুকুম দিতে না পারলেও এ দেশের দুঃসাহসী ছাত্র ও যুবকরা প্রশিক্ষণ নিয়ে শত্রুকে মোকাবিলা করেছে এবং বিজয়ের প্রদীপ্ত সূর্যকে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে ছিনিয়ে এনেছে। তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে রেখে বাঙালির স্বাধীনতার এই পদচারণকে স্তব্ধ করতে পারেনি। তাই আজও আমার ধারণা, বিশ্বাস, প্রত্যয় ও প্রতীতি, কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিজয়ী হতে হলে জাগ্রত জনতার নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে একটি বিশ্বাস ও প্রতীতির মশাল জ্বালতে হয়। তা না হলে নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো সেই নেতৃত্ব আস্তে আস্তে নিষ্প্রভ হয়ে আসে। তাই আমার বিনম্র পরামর্শ, গণতন্ত্রকে সজীব ও সতেজ করতে হলে বিএনপি নেতৃত্বকে সব ধরনের জড়তা কাটিয়ে সম্মুখভাগে এগিয়ে আসতে হবে। জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে না পারলে, নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না, আন্দোলন সফল হবে না। শুধু নির্বাচন বর্জন এবং এই বর্জনের জন্য মানুষের মানসিকতাকে প্রস্তুত করার কোনো প্রয়াসই সফল হবে না। বরং নির্বাচনী ব্যবস্থাটাই ঘুণেখাওয়া খুঁটির মতো নড়বড়ে হয়ে যাবে। নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করতে হলেও নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে নয়, বরং শক্তিশালী চিত্তে নির্বাচনের মোকাবিলা করে গণমানুষকে উজ্জীবিত ও উদ্বেলিত করে নির্বাচনে জয়লাভ করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আওয়ামী লীগের যেমন একটি শক্তিশালী সংগঠন আছে সেই সংগঠনই ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হয়েছে আন্দোলনের মধ্যে, সংগ্রামের অববাহিকায়।
তাই আজ নির্বাচন বর্জনের এই চোর-পুলিশ খেলা থেকে বেরিয়ে এসে আন্দোলনেরও স্বার্থে জনগণকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে এবং সেখান থেকেই আন্দোলনও গড়ে উঠবে, সরকারের একক শাসন থেকেও নিবৃত্ত করা যাবে।
লেখক : স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন